Wellcome to National Portal
Main Comtent Skiped

Title
দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাতের ভূমিকা শীর্ষক সেমিনার 2025
Details

দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাতের ভূমিকা শীর্ষক সেমিনার 2025

দারিদ্র্য বিমোচনে যাকাতের ভূমিকা

 

 

মাওলানা মো: আলমগীর হোসেন

প্রধান মুহাদ্দিস

পটুয়াখালী ওয়ায়েজিয়া কামিল মাদ্রাসা।


الحمدلله والصلاة والسلام على من لا نبى بعده اما بعد

ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও জেলা প্রশাসন পটুয়াখালী কর্তৃক আয়োজিত অদ্যকার সভার সম্মানিত সভাপতি। মাননীয় প্রধান অতিথি, পটুয়াখালী জেলার সুদক্ষ, সুযোগ্য, সৎ ও নির্ভিক জেলা প্রশাসক জনাব আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন মহোদয় । আরো উপস্থিত অন্যান্য অতিথিবৃন্দ ও সু-প্রিয় সুধি ।

সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন ও সালাম। আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ।

সম্মানিত সুধি,

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন اليوم اكملت لكم دينكم واتممت عليكم نعمتى ورضيت لكم الاسلام دينا

আর ইংরেজিতে বলা হয় Islam is the complete code of life

তাই ইসলামে ব্যক্তি , পরিবার , সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল সমস্যার কল্যাণকর সমাধান রয়েছে। আর এ গুলো সুন্দর ভাবে পরিচালনার জন্য দরকার একটি সুষ্ঠ ও সুন্দর অর্থনীতি, আর ইসলামি অর্থনীতির মূল উৎসই হল যাকাত।

আজকের বিশ্ব মানবসভ্যতা জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে প্রভূত অগ্রগতি সাধন করেছে। এর ফলে বিভিন্ন জাতি-রাষ্ট্র ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। অনেকের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। অপরদিকে দুঃখজনকভাবে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার একটি অংশ দারিদ্রতা, নিরক্ষরতা, স্বাস্থ্যহীনতা ও নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে। সম্পদবন্টনে বৈষম্য ও শোষণ প্রক্রিয়ায় নিষ্পেষিত হয়ে এসব আদমসন্তান বিপন্ন অবস্থায় দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে।  

সমাজ থেকে দারিদ্র বিমোচনে কুরআনসম্মত একমাত্র ব্যবস্থা হলো ইসলামের অন্যতম রোকন ‘যাকাত’ আর এ যাকাত শুধুমাত্র স্বর্ণ-রৌপ্যের উপরেই ফরজ নয় বরং নগদ অর্থ, ব্যবসার মালামাল, গরু-মহিষ , উট, ভেড়া-বকরি এবং জমি থেকে উৎপাদিত ফল-ফসলের ও যাকাত রয়েছে ।

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয় স্তম্ভ হচ্ছে যাকাত। ঈমানের পর নামায এবং তারপরই যাকাতের স্থান। কুরআনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ৮২ বার, সরাসরি ৩২ স্থানে যাকাতের কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে ২৮ স্থানে নামায ও যাকাত এক সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। এ মর্মে ইরশাদ হচ্ছে

  وَأَقِيمُوا الصَّلاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَارْكَعُوا مَعَ الرَّاكِعِينَ [سورة البقرة:43]

পবিত্র কুরআনে সূরা বাকারায় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ইরশাদ করেন ‘নামায কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং রুকুকারীদের সাথে একত্রিত হয়ে রুকু কর।’ (সূরা বাকারা : আয়াত ৪৩)

হযরত খালেদ ইবনে ওয়ালিদ (রাযি.) বলেছেন, ‘নামায এবং যাকাত একটি অপরটির সম্পূরক, একটি ছাড়া অন্যটি কবুল হয় না।’ এ কারণে ইসলাম যাকাত আদায়ের জন্য কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে। পূর্বেকার নবী-রাসূলদের উপরও যাকাত ব্যবস্থা ছিল। যেমন হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর উপর যাকাতের বিধান (সূরা আম্বিয়া : আয়াত ৭৩), হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর উপর যাকাতের হুকুম (সূরা মরিযাম : আয়াত ৫৫), হযরত মুসা (আ.)-এর উপর আল্লাহর নির্দেশ (সূরা আরাফ : আয়াত ১৫৬), হযরত ঈসা (আ.)-এর উপর আল্লাহর ফরমান (সূরা মরিয়াম : আয়াত ৩১)। তারই ধারাবাহিকতায় শেষনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর উপর ও একই বিধান অবতীর্ণ হয়। যাকাতের উপর হাদীসের ব্যাপক আলোচনা রয়েছে। তন্মধ্যে নিম্নবর্নীত হাদিসখানা উল্ল্যেখযোগ্য-

«بني الإسلام على خمس: شهادة أن لا إله إلا الله وأن محمداً رسول الله، وإقام الصلاة، وإيتاء الزكاة، وصوم رمضان، وحج البيت من استطاع إليه سبيلاً»

যাকাতের গুরুত্ব ও মর্যাদা বুঝার আরেকটি ফোকাস পয়েন্ট হল ইসলামের ৫টি মূল স্তম্ভের মধ্যে যাকাত বাদে কালিমা, নামায, রোযা, হজ্জ এগুলো হচ্ছে আল্লাহর সাথে বান্দার সর্ম্পক । কিন্তু যাকাত এমন একটি স্তম্ভ যার সর্ম্পক আল্লাহর সাথে তো বটেই, মানুষের প্রতি মানুষের অধিকারকেও এর সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে। ফলে এই ইবাদতটির সুফল ব্যক্তির সীমা ছাড়িয়ে, মানবজাতির সার্বিক কল্যাণকামীতায় রূপ নিয়েছে। ইসলাম যে একটি কল্যাণকর জীবনবিধান তার একটি উজ্বল দৃষ্টান্ত যাকাতের বিধান।

**যাকাত কারা দেবেন :

যাকাত কেবল স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক মুসলিম, নর-নারী যার কাছে নিসাব পরিমাণ সম্পদ আছে তার উপর ফরয।

নিসাব : নিসাব বলা হয় শরীয়ত নির্ধারিত সম্পদের সীমা বা পরিমাণকে। সাধারণভাবে ৫২.৫০ তোলা রূপা বা ৭.৫০ তোলা স্বর্ণ বা এর সমমূল্যের সম্পদকে নিসাব বলে। কারো কাছে ৭.৫০ তোলা সোনা বা ৫২.৫০ তোলা রূপা থাকলে বা উভয়টি মিলে ৫২.৫০ তোলা রূপার মূল্যের সমান অথবা অন্যসব সম্পদ মিলে ৫২.৫০ তোলা রূপার সমমূল্যের সম্পদ থাকলে সে সম্পদের যাকাত দিতে হয়। পারিবারিক দৈনন্দিন খরচ বাদে বর্তমান সময়ের ৯৫,০০০/- (১৮০০ টাকা রূপার ভরি দরে) টাকা কারো কাছে এক বছর মজুদ থাকলে শত করা ২.৫ টাকা হারে যাকাত প্রদান করা ফরজে আইন।

**যাকাত দেয়ার খাত:

আট শ্রেণীর লোক যাকাত পাওয়ার যোগ্য।

 اِنَّمَا الصَّدَقٰتُ لِلۡفُقَرَآءِ وَ الۡمَسٰکِیۡنِ وَ الۡعٰمِلِیۡنَ عَلَیۡهَا وَ الۡمُؤَلَّفَۃِ قُلُوۡبُهُمۡ وَ فِی الرِّقَابِ وَ الۡغٰرِمِیۡنَ وَ فِیۡ سَبِیۡلِ اللّٰهِ وَ ابۡنِ السَّبِیۡلِ ؕ فَرِیۡضَۃً مِّنَ اللّٰهِ ؕ وَ اللّٰهُ عَلِیۡمٌ حَکِیۡمٌ ﴿۶۰﴾

‘ফকীর, মিসকীন, আমিলুন, (তথা যাকাত আদায়ের জন্য নিয়োজিত ব্যক্তি), অমুসলিমদের ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য, দাস মুক্তির জন্য, ঋণগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধ, আল্লাহর পথে জিহাদকারী ও মুসাফিরের জন্য। এটি আল্লাহর বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়’। (সূরা তাওবা : আয়াত ৬০)

সূরা নিসার ১৬২ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের জন্য ‘আজরুন আযীম’-এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে- ‘এবং যারা সালাত আদায় করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে আমি তাদেরকে মহা পুরষ্কার দেব।’

শুধু তাই নয় আল্লাহ তাআলা সূরা জারিয়াতের ১৯ নং আয়াতে ইরশাদ করেন "তোমাদের সম্পদের মধ্যে যাচনাকারী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে । এখানে আর একটি বিষয় সু-স্পষ্ট যে আমাদের হালাল সম্পদের মধ্যে গরীবের হক আছে উহা আদায় না করলে ঐ ২.৫% এর জন্য আমাদের সমূদয় হালাল সম্পদ ও হারামে পরিণত হয়ে যায়। আর আমরা সকলেই একথা অবগত আছি যে যার হক সে ক্ষমা না করলে স্বয়ং আল্লাহ ও তা ক্ষমা করেন না।

ইসলামে যাকাত বিধান হল মানবসমাজকে অর্থনৈতিক শোষণ, অবিচার ও দারিদ্রের অভিশাপ থেকে মুক্ত করার এক চমকপ্রদ ব্যবস্থা। আল্লাহর ঘোষণা ‘মানুষের সম্পদ বৃদ্ধি করবে বলে তোমরা যে সুদ দাও, মূলত আল্লাহর কাছে তাতে সম্পদ মোটেই বৃদ্ধি পায় না। কিন্তু তোমরা যে যাকাত আদায় কর একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করার উদ্দেশ্যে তা অবশ্য দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়।’ (সূরা রূম : আয়াত ৩৯)

আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রতিদানের এই প্রতিশ্রুতি শুধু আখেরাতের জন্য নয়, দুনিয়ার জীবনের জন্যও। তাই প্রকৃতপক্ষে যাকাত দানকারীরা আল্লাহর পক্ষ থেকে বিরাট মুনাফার অধিকারী হচ্ছে।

সম্মানিত সুধী, আমাদের সমাজে যাকাত আদায়ের নামে আরো একটি প্রতারণা আছে আর তা হল এক ব্যক্তির ১ কোটি টাকার যাকাত হলো আড়াই লক্ষ টাকা । অথচ কয়েক খানা  শাড়ি-লু্ঙ্গি কিনে দরিদ্র মানুষের মাঝে বন্টন করেই আমরা দায় সারার ব্যর্থ চেষ্টায় লিপ্ত হই, এটা আল্লাহর সাথে প্রতারনা ছাড়া আর কিছুই না । তাই আমরা যাকাত আদায়ের পদ্ধতিটাও হাদীস থেকে নিতে পারি , আর তা হল হুজুর স: জনৈক সাহাবি কে কিছু টাকা দিয়ে কুঠার কিনে কাঠ কাটার পরামর্শ দিয়েছিলেন, আর কিছু টাকা দিয়ে খাবার কিনে নিতে বলেছিলেন । আমরাও সে ভাবে যাকাতের অর্থ দিয়ে একজন কে একটি উপার্জনের অবলম্বন করে দিতে পারি । অতএব আপনার আমার যাকাতের টাকাই পারে একটি দেশকে দরিদ্র মুক্ত করতে। তাই রাষ্ট্রীয়ভাবে এই যাকাত ব্যবস্থার সুষ্ঠু প্রয়োগ  থাকা খুবই জরুরী। সেই সাথে বিত্তবানদের সম্পদে অভাবীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষবৃক্ষটিকে সমূলে উপড়ে ফেলাই হল ইসলামের লক্ষ্য। এভাবে সমাজতন্ত্রের মত অযৌক্তিক সমতা প্রতিষ্ঠা বা পুঁজিবাদের মত সম্পদের একচেটিয়া ভোগাধিকার এর পরিবর্তে ইসলাম ইনসাফের ভিত্তিতে একের সম্পদে অন্যের অধিকার প্রতিষ্ঠার এক শাশ্বত ও কার্যকর মানদন্ড পেশ করেছে।

আল্লাহ তা’আলা আরো ইরশাদ করেন ‘আর তাদের জন্য নিদর্শন হল মৃত ভূমি, আমি একে সঞ্জীবিত করি এবং তা থেকে উৎপন্ন করি শস্য, তারা তা থেকে ভক্ষণ করে। আমি তাতে সৃষ্টি করি খেজুর ও আঙ্গুরের বাগান এবং তাতে সৃষ্টি করি ঝর্ণা, যাতে তারা আহার করতে পারে এর ফল-মূল হতে, অথচ তাদের হাত একে সৃষ্টি করে নাই। তবুওকি এরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে না?’ (সূরা ইয়াসীন : আয়াত ৩৪ ,৩৫)

সম্মানিত সুধী, ইসলামের পঞ্চস্তম্ভ এর কোন একটি আমল না করলে ব্যক্তি ফাসিকে পরিণত হয়। আর অস্বীকার করলে কাফেরে পরিণত হয়। হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু যাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। এ থেকে বুঝতে পারি যে যাকাত আদায় না করা কত বড় অপরাধ। আর এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন-

  وَالَّذِينَ يَكْنِزُونَ الذَّهَبَ وَالْفِضَّةَ وَلَا يُنفِقُونَهَا فِي سَبِيلِ اللَّهِ فَبَشِّرْهُم بِعَذَابٍ أَلِيمٍ )

‘‘আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহর পথে ব্যয় করে না তুমি তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও’’। (সূরা তাওবা, আয়াত ৩৪)

সেদিন জাহান্নামের আগুনে ঐগুলিকে উত্তপ্ত করা হবে অতঃপর ওই গুলি দ্বারা তাদের ললাট সমূহে, পার্শ্বদেশ সমূহে, পৃষ্ঠদেশ সমূহে দাগ দেয়া হবে। আর বলা হবে এটা হচ্ছে ওটাই যা তোমরা নিজেদের জন্য সঞ্চয় করে রেখেছিলে। সুতরাং এখন নিজেদের সঞ্চয়ের স্বাদ গ্রহণ করো। আর হাদীস শরীফে এসেছে হযরত ইবনে জারির, হযরত সাওবান রাদিয়াল্লাহু হতে বর্ণনা করেছেন রাসূল সা: বলেছেন যে ব্যক্তি তার পিছনে সঞ্চিত ধন রেখে যাবে উহার যাকাত দিবে না, কেয়ামতের দিন তার ওই সম্পদ বিষাক্ত অজগর সাপের রূপ ধারণ করবে। যার চক্ষুদ্বয়ের উপর দুটি বিন্দু থাকবে। সাপটি ওই ব্যক্তির পিছনে পিছনে ছুটবে, লোকটি তখন পালাতে পালাতে বলবে, তোমার অমঙ্গল হোক! তুমি কে? উত্তরে বলবে আমি তোমার জমাকৃত সম্পদ যা তুমি তোমার পিছনে ছেড়ে এসেছিলে। শেষ পর্যন্ত সাপটি তাকে ধরে ফেলবে এবং তার হাত ও সারা দেহকে চিবাতে থাকবে। (তাবারী: ৬/৩৬৩, ইবনে হিব্বান-৮০৩, ইবনে খুজাইমা-২২৫৫, বুখারী শরীফ-৪৬৫৯)

** যাকাত ব্যবস্থার গুরুত্ব :

প্রথমত আর্থিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধিতা অর্জন। এ ব্যাপারে আল্লাহর নির্দেশ হল ‘তাদের ধন-সম্পদ থেকে যাকাত উসূল করে তাদেরকে পবিত্র এবং পরিচ্ছন্ন করে দাও।’ (সূরা তাওবা : আয়াত ১০৩)

অন্যত্র এসেছে ‘খালেছভাবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে তারা এতীম, মিসকীন এবং বন্দীদের খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয় এবং তারা বলে যে, আমরা তোমাদেরকে কেবল আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্যই খাওয়াচ্ছি। তোমাদের কাছে আমরা কোনরূপ বিনিময় বা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ চাই না।’ (সূরা দাহর : আয়াত ৮/৯)

এখানে প্রথম আয়াতটি আর্থিক পরিশুদ্ধিতার অনন্য দলিল। এই আয়াতগুলোর সঠিক মর্ম উপলব্ধির জন্য ইসলামের ভ্রাতৃত্ব নীতির সাথে মিলিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। সূরা হুজরাতের ১০ নং আয়াতে বলা হয়েছে ‘মুমিনরা তো পরস্পর ভাই ভাই।’ এর ভিত্তিতেই হাদীসে এসেছে মুমিনরা সবাই মিলে একটি দেহের মত, এর কোন একটি অঙ্গ রোগাক্রান্ত হলে সর্বাঙ্গে তার প্রভাব পড়ে। এজন্য এক দারিদ্রপীড়িত ভাইয়ের অভাবের কষ্টগুলোর তার একার থাকে না; বরং অন্যরাও তার দুঃখ-কষ্টের ভাগীদার হয়।

তাই স্বাভাবিকভাবেই এক হল স্বচ্ছল ভাইয়ের সম্পদে আরেক অভাবী ভাইয়ের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলাম এটাকে তাদের প্রতি করুণা নয় বরং তাদের প্রাপ্য হিসেবেই পেশ করেছে। এ ব্যাপারে (কুরআনের ভাষ্য হল) ‘গরীব নিকটাত্মীয়দেরকে তাদের প্রাপ্য দাও এবং মিসকীন ও গরীব মুসাফিরকেও।’ (সূরা বনী ইসরাঈল : আয়াত ২৬)

এজন্যই কুরআনে যাকাত আদায়ের মাধ্যমে সম্পদকে পবিত্র করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যে ব্যাক্তি নিজের উপার্জিত সম্পদে অন্যের অধিকার স্বীকার করে নেয়, সে অত্যন্ত মহৎ ব্যক্তিত্বের পরিচয় প্রদান করে। এটা তাকে স্বার্থপূজা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও মনের সঙ্কীর্ণতা, তথা কৃপনতা থেকে রক্ষা করে। যে ব্যক্তি আল্লাহর নির্দেশ পালনে এত বড় আর্থিক কুরবানী করতে প্রস্তুত হয়ে যায়, জীবনের আর সব দিকে সে আল্লাহর অবাধ্য হতে পারে না। অপরদিকে মানুষের হক আদায়ে যে সদা সচেতন, তার দ্বারা কখনো অন্যের ক্ষতি হতে পারে না। কেননা তার সম্পদের এই নির্ধারিত অংশটিতে তার নিজের কোন অধিকার নেই। এটা যার প্রাপ্য তাকেই বুঝিয়ে দিতে হবে। যদি সে এটা দিতে অস্বীকার করে তবে সে অন্যের সম্পদ আত্মসাতের দায়ে অভিযুক্ত হবে। আর এই বিধানের আলোকে কোন ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কারো সম্পদ বা সম্ভ্রমে কখনো অন্যায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যাকাত আদায়কারী ব্যক্তির আর্থিক ও আত্মিক পরিশুদ্ধিতায় একটি কার্যকরী প্রশিক্ষণ পেয়ে যায়।

দ্বিতীয় : বিষয়টি হল আর্থিক নিশ্চয়তা প্রদান। অর্থনৈতিক জীবনে অনিশ্চয়তা মানুষকে সবচেয়ে বেশি অপরাধপ্রবণ করে তুলে। যে সমাজে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা যতবেশি থাকে, সেখানে চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, আত্মসাত, হত্যা, লুণ্ঠনের মতো ভয়াবহ অপরাধগুলো তত বেশি প্রভাব বিস্তার করে। তাই ইসলাম মানুষকে ক্ষুধা-দারিদ্রের অভিশাপ থেকে মুক্তি প্রদান করে একজন সৎ মানুষ হিসেবে জীবন যাপনের পথ প্রশস্ত করতেই যাকাতের মতো একটি কল্যাণকর সামাজিক বিধান দিয়েছে।

তৃতীয়ত: ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করে ইনসাফভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা। ইসলামে কখনো বাহ্যিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষে মানুষে পার্থক্য করা হয় না। এ ব্যাপারে ইসলামের নীতি হল ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি তাকওয়াবান, সেই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক সম্মানিত।’ (সূরা হুজুরাত : আয়াত ১৩)

তাই সমাজে অর্থের ভিত্তিতে মর্যাদার মাপকাঠি নির্ধারণের প্রথাকে ইসলাম ভেঙ্গে দিতে চায়। এখন প্রশ্ন হল, যাকাত আদায় ও বণ্টনের কাজটা করবে কে? রাষ্ট্রের প্রতিটি সম্পদশালী সচেতন নাগরিককে এ দায়িত্ব নিতে হবে। যাকাতের মাধ্যমে দারিদ্র জয়ের অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও যথাযথ পদক্ষেপ ও ব্যবস্থাপনার অভাবে যদি মানুষ দারিদ্রের অভিশাপ থেকে মুক্তি না পায়, তাহলে এ অবহেলার জন্য কিয়ামতের ময়দানে আমাদের সকলকে আল্লাহর কাছে জবাব দিতে হবে।

সুতরাং সম্পদশালী জনগণের উচিত হল যাকাত দেয়া আর রাষ্ট্র পরিচালনাকারীদের কর্তব্য হল যাকাত ব্যবস্থাপনা আইন করে যাকাত আদায় করে গরীব মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। যাকাত আদায় ও বণ্টনের জন্য সরকারী যাকাত বোর্ড এ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক ও উপ পরিচালক ইসলামিক ফাউন্ডেশন মহোদয়ের সমন্বয়ে একটি যাকাত কমিটিও আছে। তবে আলাদাভাবে একটি শাখা হলে ইসলামী বিধান অনুসারে যাকাত আদায় ও বন্টনের জন্য মানুষের কর্মসংস্থানেরও সুযোগ হবে।

আর বাংলাদেশের মত একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে ইসলামিক ফাউন্ডেশন এ মহত কাজটি এগিয়ে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই আপনার মত একজন সৎ ও যোগ্য জেলা প্রশাসকের সার্বিক সহযোগিতা থাকলে পটুয়াখালী জেলা ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক যাকাত আদায় ও সুষ্ঠ বণ্টনে বাংলাদেশের জন্য রোল মডেলে পরিণত হবে বলে আমরা শতভাগ আশাবাদী।

আল্লাহ আমাদের সহায় হঊন।

আমীন-

Image
Publish Date
11/03/2025
Archieve Date
30/04/2026